স্ট্যাটিন খাওয়ার আগে ৩৩বার ভাববেন এই লেখা পড়ার পরে

উৎসঃ ডাঃ পল মেসনের উপস্থাপনা https://youtu.be/Odvt4EaGPLw

ভিডিওটির ধারা বর্ণনা বাংলায় অনুবাদ করেছেন, মোঃ শাহাদাৎ হোসেন (simplyShahadat@gmail.com)।

শুভেচ্ছা সকলকে! আমি ডাঃ পল মেসন। আজ আমি আপনাদের স্টাটিন ঔষধের ইতিহাস সম্পর্কে বলব এবং দেখাব কেমন করে বিজ্ঞান কে কলুষিত করা হয়েছে।

সারা পৃথিবীজুড়ে কোটি কোটি মানুষ স্টাটিন ব্যবহার করেন। এটি অত্যন্ত লাভজনক একটি ঔষধ এবং ‘লিপিটর’ যেটা এই চিত্রে নিচের বাম কোনায় দেখতে পাচ্ছেন, সেটি বছরে ১৫০ বিলিয়ন আমেরিকান ডলারেরও বেশী বিক্রি হয়। তাহলে প্রথম প্রশ্ন হল, স্টাটিন এত জনপ্রিয় হল কি করে?

এই গল্পের শুরু হয় ১৯১৩ সালে, এই ব্যক্তিকে দিয়ে। তিনি রাশিয়ান একজন বিজ্ঞানী যার নাম নিকলেই আনাকভ।

তিনি খরগোশদের জোর করে শুধুই খাঁটি কোলেস্টেরল খাওয়ান এবং  তাদের মধ্যে এথেরস্ক্লেরসিস ঘটাতে সক্ষম হন। পরবর্তীতে তার এই আবিষ্কারই চর্বি-হৃদরোগ তত্বের জন্ম দেয়। এই তত্বের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে যে খাদ্যের সম্পৃক্ত চর্বি এবং কোলেস্টেরলই হৃদরোগের কারন। কোলেস্টেরল যে তৃণভোজী খরগোশের খাবার নয় এবং এদের এথেরস্ক্লেরসিস যে মানুষের থেকে ভিন্ন, এই কথাগুলো বিবেচনায় আনা হয় নি। 

এর ফলে দেখা যায়, ১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি, সারা পৃথিবীজুড়ে ঔষধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো হন্যে হয়ে রক্তের কোলেস্টেরল মাত্রা কমাবার একটা ঔষধ আবিষ্কারের চেষ্টা করছে তাদের গবেষণাগার গুলোতে।

এদেরই মধ্যে একটি কোম্পানি হল উইলিয়াম এস মিনারেল কোম্পানি, যারা আমেরিকায় ‘ফালিডিমাইড’ ঔষধটি চালু করেছিলো। তারা কোলেস্টেরল কমাবার একটি ঔষধ খুঁজে পান যার নাম টপ্যারানল, অন্য নামে যাকে মার-২৯ বলা হত। ১৯৫৯ সালে এই ঔষধটি এফ ডি এ এর অনুমোদন পায়, যা অতিদ্রুত বাণিজ্যিক সফলতা লাভ করে। 

আর্থিক লাভের কথা বাদ দিলে, দেখা যায় এটি ছিল স্বাস্থ্যগত দিক থেকে একটি অপূরণীয় সর্বনাশ। ১৯৬২ সালে, বহু মানুষ এর মারাত্বক এবং স্থায়ী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় খতিগ্রস্থ হবার পর, এই ঔষধকে বাজার থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। 

উদাহরণ হিসাবে, এখন আপানারা দেখতে পাচ্ছেন একটি ৬ বছর বয়সী শিশুর চোখে স্থায়ী ছানি যার কারন ছিল এই ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। অন্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে ছিল চুল পড়া, ত্বকের অসুখ এবং এথ্রস্ক্লেরসিস এর গতি বেড়ে যাওয়া, অথচ হাস্যকর কথা হল, এর চিকিৎসার জন্যেই এই ঔষধ আবিষ্কার করা হয়েছিলো। এই সবগুলো স্বাস্থ্য ক্ষতির কারন ছিল এই ঔষধ যা দেহের প্রাকৃতিক কোলেস্টেরল উৎপাদন ব্যহত করছিলো। এই পদ্ধতি যে ভালো কোন পদ্ধতি নয়, তা যেন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো। 

এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলোতে অবাক হবার মতও কিছু ছিল না। পশুদের উপর করা প্রাথমিক পরীক্ষায় এমন একাধিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ধরা পরেছিল। এই ইঁদুরটির কথাই ধরুন। ৯ সপ্তাহ ধরে ট্রিপারানল খাওয়ানোর পরে, ৪৪ টি ইঁদুরের মধ্যে এই একটিই বেঁচেছিল।

১৯৬৩ সালে আমেরিকার গ্র্যান্ড জুরি জানতে পারে যে উইলিয়াম এস মিনারেল কোম্পানি শুধু এই ঔষধের ঝুঁকির কথা গোপনই করেনি, বরং মিথ্যা তথ্যও দিয়েছিল। যেমন, গ্রাফ পরিবর্তন করে উপকার দেখানো হয়েছে, চুল পড়া কে অন্য কারনে হয়েছে বলে দাবী করা হয়েছে, ছানি পরার কথা নথিতে লিপিবদ্ধ করা হয়নি ইত্যাদি। এমনকি কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের শেখানো হয়েছিল কি করে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দোষ অন্য ঔষধের উপর দিতে হবে। এই কোম্পানিকে প্রাথমিক ভাবে ৮০ হাজার ডলার জরিমানা করাহয় এবং পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে খতিগ্রস্থ গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ এবং মামলার খরচ হিসাবে ব্যয় হয় আরও ৫০ মিলিয়ন ডলার।

এর ফলে একটি শূন্যতা সৃষ্টি হয় যার ভিত্তি ছিল প্রথমত একটি বিশ্বাস যে কোলেস্টেরলই হৃদরোগের কারন এবং দ্বিতীয়ত বাজারে কোলেস্টেরল কমাবার কোন ঔষধ না থাকা। আর এই শূন্যতা থেকেই স্টাটিন ঔষধের জন্ম হয়। ১৯৭৬ সালে জাপানি বিজ্ঞানী একিরও এন্ড, একটি মাইকো টক্সিন বের করেন যার নাম এম এল ২৩৬বি, যা প্রথম পরীক্ষা মূলক স্টাটিন হিসাবে ব্যাবহ্রিত হয়। ১৯৭৯ সালের মধ্যেই জাপানি ফারমাসিটিক্যাল কম্পানি সিনকায়ো এবং আমেরিকার মার্ক দেখা গেল একই স্টাটিন এর উপর গবেষণা করছে। তারা প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হল যে কে প্রথমে স্টাটিন বাজারে আনতে পারে। তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, জয় যার হবে, সে বিশাল অঙ্কের লাভ করবে। কিন্তু ১৯৮০ সালে সিনকায়ো, এই প্রতিযোগিতা থেকে সরে আসে কারন তারা দেখতে পান যে, যে কুকুর গুলোর উপরে তারা পরিক্ষামুলকভাবে স্টাটিন ব্যাবহার করেছেন, তাদের অর্ধেকেরই ক্ষুদ্রান্ত্রের ক্যান্সার লিম্ফোমা হয়েছে। তারা সিদ্ধান্ত নেন যে এই ঔষধটি মানুষের ব্যবহারের জন্য অত্যাধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং গবেষণা বন্ধ করে দেন। মার্ক ও কিছুদিন পরে একই সিদ্ধান্তে পৌছায়। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে মার্ক এর বিজ্ঞানীরা স্টাটিন নিয়ে গবেষণা পুনরায় শুরু করার অনুমোদনের জন্য চেষ্টা চালাতে থাকে। এই উদ্দেশ্যে তারা জাপানিদের গবেষণাকে খাট করতে দাবী তোলেন যে জাপানি বিজ্ঞানীগণ তাদের কুকুরগুলোর ক্যান্সার সনাক্ত করতে ভুল করেছিলেন, যেন এমন বোকার মত ভুলও বিজ্ঞানীরা করেন। এই বলে তারা তাদের গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। শেষে ১৯৮৭ সালে, মার্ক প্রথম স্টাটিন এর জন্য এফ ডি এ এর অনুমোদন লাভ করে। এটা ছিল সেই একই স্টাটিন যা সিনকায়ও মানুষের জন্যে ক্ষতিকর বলে ঘোষণা করেছিলো। 

এর নাম ‘লোভাস্টাটিন’। কিন্তু সেখানেই এই গল্পের শেষ নয়। ১৯৯০ সালে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ বিশেজ্ঞদের নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে যার আলোচ্য বিষয় ছিল যে কোলেস্টেরল কমানো আসলে স্বাস্থের পক্ষে ক্ষতিকর কিনা। এবং এই বিশেষজ্ঞ প্যানেল এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হন যে, কথাটি সত্য হতেও পারে। তার পরে ২০০১ এ ফারমাসিউটিক্যাল কোম্পানি ‘বেয়া’, বেশ কিছু রোগীর দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পরে, বেইকল নামে তাদের স্টাটিন ঔষধ বাজার থেকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। এই শতাব্দীতে ঘটে থাকলেও, অনেকই জানেন না যে ‘বেয়া’ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশী খরচ করেছে তাদের বিরুদ্ধে করা হাজার হাজার ক্ষতিপূরণের মামলা মেটাতে, যেই ক্ষতির মুলে ছিল তাদের স্টাটিন। 

স্টাটিন এর সম্ভাব্য ক্ষতির তালিকাটি খুবই লম্বা। এর থেকে ডিমেশিয়ার মত উপসর্গ দেখা দিতে পারে। 

হাড়ক্ষয় বা অস্টিওপরসিস এর ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

দেহে তেস্টস্টেরনের মাত্রা কমায়। 

ইরেক্টাইল ডিস্ফাংশন বা ধ্বজ ভঙ্গ রোগ এবং শুক্রাশয়ের আকার ছোট হয়ে জাওয়ার সাথে সহ-শংঘটিত

এমন কি এটা ডায়বেটিসের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয়। উদাহরণ স্বরূপ, উইমেনস হেলথ ইনিশিয়েটিভ গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে, এটি মহিলাদের ডায়বেটিস হবার ঝুঁকি প্রায় ৭১% বাড়িয়ে দেয়। 

এমনো নয় যে এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা গোপন, বরং স্টাটিন ঔষধের প্যাকেট এর ভেতর যে তথ্যপত্রটি দেয়া থাকে, সেটি খুললে আপনি নিজেও দেখতে পাবেন তারা যে বিষয় গুলো নিয়ে সতর্ক করেছেন, তার মধ্যে আছে 

লিভার ক্যান্সার 

ভীষণরকম পেশীর ক্ষতির সম্ভবনা

এমনকি একটি সতর্কবাণীতে তারা, ৬৫ বছরের বেশী বয়স্কদের স্টাটিন দেবার বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেছেন। আর আছে, 

প্রস্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া

ডায়বেটিস হবার অধিক ঝুঁকি  ইত্যাদি।

বাজারজাত করার পরপর যে তথ্য পাওয়া যায় ব্যাবহারকারিদের কাছ থেকে, সেটা আরো চমকপ্রদ। সেখান থেকে জানা যায় যে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে আছে বিষণ্ণতা, ঘুমাতে না পারা থেকে শুরু করে ফুসফুসের রোগ এবং গাইনোকামাশ্চিয়া (পুরুষদের স্তন বড় হয়ে যাওয়া)।

তবে  যদি কেউ এই আশ্বাস দেন যে স্টাটিন এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুবই নগণ্য, অবশ্যই সেটা রোগীদের আস্থা বাড়ায়। যেমন, স্টাটিন ব্যবহারকারী প্রতি শত জনের মধ্যে ১ জনেরও কম ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়। অথবা প্রতি ২০০ জনের মধ্যে একজনের হতে পারে। আর এমন দাবী যদি আসে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির অভিজ্ঞ প্রফেসর ডঃ ররি কলিন্স এর মুখ থেকে, তাহলে তো আর কোন কথাই থাকে না। 

তবে পুরো বিষয়টি বেশ ঘোলাটে হয়ে দাড়ায়, যখন সেই একই ডঃ ররি কলিন্স, স্টাটিন এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় কেউ ভুগছেন কিনা তা নির্ণয় করার জন্য একটি পরীক্ষা উদ্ভাবন করেন এবং সেই উদ্ভাবন যেন কেউ নকল করতে না পারে, তার অধিকার বা পেটেন্ট এর জন্য আবেদন করেন। অথবা যে ওয়েবসাইট তার উদ্ভাবিত পরীক্ষা বিক্রি করছে, সেখানে দাবী করা হয় যে প্রায় ২৯ শতাংশ মানুষ যারা স্টাটিন ব্যবহার করেন, তাদের পেশী তে ব্যথা সহ অন্যন্ন পারস্বপ্রতিক্রিয়া হয়। 

সত্য হচ্ছে যে, ০.৫% থেকে ১% এর পরিবর্তে ২৯% সংখ্যাটিই সঠিকের কাছাকাছি। দেখা যাচ্ছে স্টাটিন এর গবেষণা এমনভাবে নক্সা করা হয় যেন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সংখ্যাটি বাস্তব থেকে কম হিসাবে দেখানো যায়। উদাহরণ হিসাবে ধরুন এই বিশাল গবেষণাটির কথা, যেখানে গবেষণার কাল বা রানিং পিরিয়ড বলে একটি ধারনা ব্যাবহার করা হয়েছে। অংশগ্রহণকারীদের সকলকে মূল গবেষণা শুরুর আগে প্রথমে ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ ধরে, প্রথমে একদম একই রকম দেখতে ঔষধ বিহীন বড়ি খাওয়ানো হয় এবং এরপরে আসল ঔষধ দেয়া হয়। এই সময়ে কেউ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দাবী করলে, তাদেরকে মুল গবেষণা থেকে বাদ দেয়া হয়। এই উপায়ে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় এক তৃতীয়াংশ বা এগার হাজারেরও বেশী অংশগ্রহণকারী কে শুরুতেই বাদ দেয়া হয়। গবেষণা শুরুর আগেই যদি, যাদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা বেশী তাদেরকে বাদ দেয়া হয়, তাহলে মূল গবেষণায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার হার কম হবে, এত সহজেই বোঝা যায়।

বাস্তবতা হল এই যে, প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে একজন প্রচলিত মাত্রার স্টাটিন থেরাপি সহ্য করতে পারেন না যা ফারমাসিউটিকলস কোম্পানির করা গবেষণা থেকে জানা যায়। আরও আধুনিক এবং দামি একটি স্টাটিন গবেষণার বিবরণপত্রের মাঝে অল্প কথায় লেখা ছিল যে, সহনীয়তা পরিমাপ করতে গিয়ে কমপক্ষে দুইজন ডাক্তার এই বিশাল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন; সাথে এটাও মনে রাখবেন যে, রোগীদের যদি বলা হয় যে এই ঔষধ তাদের আয়ু বাড়াবে, তাহলে তারা স্বল্প মাত্রার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সহ্য করতেও রাজি থাকেন। তার অর্থ হচ্ছে যে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারনে যদি কেউ স্টাটিন না খেতে পারেন, তাহলে তাদের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া মোটেও সামান্য নয়। 

তাহলে এর পরে যে প্রশ্নটি এসে যায়, তা হল, এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুলো থাকা সত্ত্বেও, মৃত্যুকে দুরে ঠেলে দিতে স্টাটিন কতটা কার্যকর? আরো সহজ করে বললে, কি মাত্রায় কতদিন স্টাটিন খেলে, একজনের আয়ু কতটা বাড়বে? আর এই চমৎকার গবেষণাটি সেই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে, কোন বাছবিচার ছাড়াই এযাবৎ প্রকাশিত সব গুলো স্টাটিন গবেষণা থেকে তথ্য নিয়ে। এতে তারা ১১টি গবেষণা থেকে উপাত্ত ব্যবহার করেন, যেই গবেষণাগুলোতে অংশ নিয়েছিল ৯০ হাজারেরও বেশী মানুষ। এই গবেষণায় দেখা যায় যে, যারা একবার হার্ট অ্যাটাক হবার পরে স্টাটিন ব্যাবহার শুরু করেছেন, গড়ে তাদের আয়ু বেড়েছে ৪.৫ দিন। আর যাদের হৃদরোগ আগে ছিল না, তাদের ক্ষেত্রে ৩.২ দিন। অর্থাৎ বহু বছর ধরে স্টাটিন ব্যাবহার করার পর, লোকের আয়ু বাড়ে ৩ থেকে ৪ দিন। সাথে লক্ষ্যনীয় যে, এই গবেষণাটির ফল স্টাটিনের পক্ষে যাবার একাধিক কারন আছে, অর্থাৎ এই ফল পক্ষপাত মুক্ত নয়। 

প্রথমত, এই গবেষণায় স্টাটিনের উপর করা সব গবেষণাকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়নি কারন ঔষধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো তাদের করা গবেষণার বিস্তারিত উপাত্ত নিরপেক্ষ  বিচার-বিস্লেশনের জন্য প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। এই সমস্যার এখনো কোন সমাধান করা যায়নি। 

এবারে আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি স্টাটিন ব্যবহারের উপর করা আর সি টি বা নিরপেক্ষ-নিয়ন্ত্রিত গবেষণাগুলোর তথ্য নির্ভর একটি মেটা এনালিসিস যা এই বছর (২০২১) ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত হয়েছে। এতে পাওয়া যায় যে ৫০ থেকে ৭৫ বছর বয়সীরা স্টাটিন ব্যবহার করলেও তাদের আয়ু বাড়ে না। লক্ষণীয় যে, এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৮টি গবেষণার মাত্র একটিতে উপকার পাবার দাবী করা হয়। জুপিটার ট্রায়াল নামে পরিচিত এই গবেষণায়, তারা উচ্চ মাত্রায় যাদের এল ডি এল রয়েছে, তাদেরকে অংশ নিতে দেন নি। জ্বি, ঠিকই শুনেছেন, উচ্চ মাত্রায় এল ডি এল এর উপর স্টাটিনের প্রভাব বিশ্লেষণ কে তারা এই গবেষণা থেকেই বাদ দেন। তার উপরে, সব অংশগ্রহণকারীর সি রিয়্যাক্টিভ প্রোটিন বা সি আর পি হতে হয়েছিল ২ বা তার কম। খেয়াল করুন যে সি আর পি হচ্ছে দেহের প্রদাহের মাত্রার নির্দেশক যা হৃদরোগের সাথে সম্পৃক্ত।  আর এমন সাঙ্ঘাতিক রকম সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও, যারা স্টাটিন ব্যাবহারকে উৎসাহিত করেন, তারা এই গবেষণাটিকেই বার বার তাদের পক্ষের প্রমাণ হিসাবে তুলে ধরেন যা অন্য গবেষণা গুলোকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা বলেই প্রতীয়মান হয়। 

এছাড়াও, প্রচার মাধ্যমে এই জুপিটার ট্রাইয়াল গবেষণাটির প্রশংসার দিকে নজর দিলে দেখা যায় খারাপকে ভালো হিসাবে  উপস্থাপনের একটি চেষ্টা। 

জুপিটার ট্রায়াল ভিত্তিক প্রকাশনা গুলো সর্বাধিক চাঞ্চল্যকর। উদাহরণ হিসাবে “দ্যা নিউ ইয়র্ক টাইমস” এ প্রকাশিত এই প্রবন্ধটির কথা ধরুন। এতে বলা হয় যে স্টাটিন ব্যবহারকারীদের স্ট্রোক সম্ভাবনা, স্টেন্ট প্রয়োজনীয়তা এবং বাইপাস সার্জারির প্রয়োজনীয়তা ৫০% কমে যাবে! শুনতে অত্যন্ত চমৎকার, তাই না? 

চলুন আমরা একটু ঘেটে দেখি। তাদের দাবী দেখা যাচ্ছে, পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়কে একত্র করে করা, যা শুরুতেই একটি সমস্যা। বিষয়গুলো হল ১) মৃত্যু ঘটায় নি এমন হার্ট অ্যাটাক হওয়া ২) মৃত্যু ঘটায়নি এমন স্ট্রোক হওয়া ৩) এঞ্জাইনা জনিত কারনে হাসপাতালে যেতে হাওয়া ৪) হৃদরোগ জনিত মৃত্যু এবং ৫) আরটেরিয়াল রি ভাস্কুলারাইজেশন এর ব্যাবহার। এই কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, কেউ আরটেরিয়াল রি ভাস্কুলারাইজেসন ব্যবহার করলেই, যেমন স্টেন্ট বসালেই, তা থেকে এটা প্রমানিত হয় না যে তা আবশ্যকীয় ছিল। যাই হোক, এই সবগুলো বিষয়ে উপকার হবার সম্ভাবনাকে একত্রে যোগ করে, জুপিটার ট্রায়াল দাবী করে ৪৪% ঝুঁকি কমা। 

কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই ৪৪% আপেক্ষিক ঝুঁকি কমার অর্থ আসলে কি? এই গবেষণা চলাকালীন সময়ে স্টাটিন ব্যাবহারকারি দলের ১.৫% মানুষ এবং ঔষধ বিহীন স্টাটিনরূপি বড়ি খাওয়া দলের ২.৭% মানুষদের এই পাঁচটির কোন একটি বা একাধিকের প্রয়োজন হয়েছিলো। তাহলে এখন এদেরকে পাশাপাশি রেখে তুলনা করলে, আসলেই দেখা যায় যে ১.৫ হচ্ছে ২.৭ এর থেকে ৪৪% কম। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কতটা পার্থক্য হয়েছিলো, সেটা বোঝাবার জন্যে আমি এই গ্রাফে দুটো কে পাশাপাশি বসিয়ে দেখিয়েছি। এই চিত্রটিকে তেমন হৃদয়গ্রাহী আর মনে হচ্ছে না, তাই না? 

এবং এখন দেখাচ্ছি মৃত্যু ঘটিয়েছে বা ঘটায়নি এমন হার্ট অ্যাটাক এর তুলনা মূলক চিত্র। যেমন দেখতে পাচ্ছেন যে, জুপিটার ট্রায়াল এর স্টাটিন ব্যবহারকারী এবং বিহীন দলের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক সংখ্যার পার্থক্য প্রায় নজরেই পরে না। অথচ এই চিত্রকেই ৫৪% আপেক্ষিক ঝুঁকি হ্রাস হিসাবে দাবী করা যায়। 

একটু ভেবে দেখুন যে কি হতে পারে যদি আমরা এমন দুরভিসন্ধিমূলক প্রচার কে একটু ঘুরিয়ে ব্যাবহার করি? যেমন স্টাটিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তথ্যকেও আমরা বাস্তব চিত্র উপস্থাপনের পরিবর্তে আপেক্ষিক রূপে উপস্থাপন করি? এখানে উপস্থাপিত নিউ ইয়র্ক টাইমস এর লেখাটির শিরোনাম ইংগিত দিচ্ছে যে স্টাটিন স্মৃতি শক্তির উপর প্রভাব ফেলে না। 

চলুন হিসেব করে দেখি। প্রায় ৪ লক্ষ ৯০ হাজার স্টাটিন ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩৭৬ জন দাবী করেছেন যে তারা স্বল্প মেয়াদে স্মৃতি শক্তি হারিয়েছেন। ওদিকে স্টাটিন না ব্যবহারকারী দলের ১১৪ জনের ক্ষেত্রে ঘটেছে এই ঘটনা। আপেক্ষিক তুলনা ব্যবহার করলে, এর অর্থ দাড়ায় যে স্টাটিন ব্যবহারকারীদের স্মৃতিশক্তি হারানর ঝুঁকি প্রায় ৩০০% বেশী। এরপরে স্টাটিন ব্যবহারের সাথে অসম্পর্কিত ঘটনাগুলোকে বাদ দিলে, এই ঝুঁকি বেড়ে দাড়ায় ৪২০%। স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জাগে যে নিউ ইয়র্ক টাইমস এর উপর ভিত্তি করে এমন খবর লিখল না কেন, যে স্টাটিন ব্যবহার স্মৃতিশক্তি হারাবার ঝুঁকি ৪ গুন বাড়িয়ে দেয়। 

আমি মনে করি, এখানে শিক্ষণীয় বিষয় হল যে, খবরের কাগজ থেকে স্বাস্থ্য শিক্ষা লাভের চেষ্টা করা বোকামি। কিন্তু বিপদ হচ্ছে যে, ডাক্তারগণও আমাদের কে এর থেকে ভালো কিছু দিতে পারছেন না, যে বিষয়ে আমি ভবিষ্যতে আলোচনা করব। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারদেরকে জোর করে এমন কাজ করানো হয়, যেমন রোগীকে স্টাটিন ব্যবহার করতে বলা, যদিও তা উপকারী হবে বলে তারা বিশ্বাস করেন না। শেষ কথা হচ্ছে, আপনার অধিকার আছে, আপনার চিকিৎসকের উপদেশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার, এবং যে তথ্যপ্রমাণের উপর নির্ভর করে চিকিৎসক এই উপদেশ দিচ্ছেন, সেই প্রমাণ দেখতে চাওয়ার। ব্যাক্তিগত ভাবে, আমি আমার রোগীদের কাছ থেকে তাই আশা করি। ধন্যবাদ!